বেঙ্গল ইনস্টিটিউটের নানান গবেষণামূলক কাজের মধ্যে ছোট শহর নিয়ে গবেষণা অন্যতম। ঢাকার বাইরের শহরগুলো কেমন, কি আছে বা নেই, কেন মানুষ শুধু ছুটে আসে রাজধানীর পানে, কি হলে ঐ শহরে বসবাস আরেকটু গোছানো হতো, এমনই হাজারো চিন্তা। এরই ধারাবাহিকতায় সিলেট সিটি কর্পোরেশনের আমন্ত্রণে শহরের গুরুত্বপূর্ণ এবং ঐতিহাসিক স্থান সমূহ পর্যবেক্ষণ করে একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। আর সিলেট নিয়ে এইসব ভাবনাচিন্তা শহরবাসির কাছে পৌঁছে দেবার প্রয়াসে সিলেটের মাছিমপুরে অবস্থিত আবুল মাল আব্দুল মুহিত ক্রীড়া কমপ্লেক্সে গত ২২শে ফেব্রুয়ারি থেকে ৩রা মার্চ ২০১৭ পর্যন্ত আয়োজন করা হয় “আগামীর সিলেট” শীর্ষক প্রদর্শনীর। স্থপতি সালাউদ্দিন আহমেদের ডিজাইন এবং নির্দেশনায় অভিনব এক বাঁশের কাঠামোতে বড় বড় ব্যানার, ফেস্টুন, মডেল দিয়ে উপস্থাপন করা হয় এক নতুন নাগরিক কল্পনা। নগর কেন্দ্রের পুরনো ও বিদ্যমান পরিস্থিতিকে সঙ্গে নিয়ে কিভাবে নিজেদের শহরটাকে সাজানো গোছানো যায়, তার প্রতিরূপ দেখতে প্রতিদিন ভিড় করেছিল হাজারো মানুষ। ছোট-বড় সবার আনন্দ করার, চিন্তার খোরাক জোগানোর জন্য এ ছিল এক অনিন্দ্য গন্তব্য।
সিলেট একেবারে ছোট শহর নয়। সিলেট ঢাকার মতোও নয়। সিলেট শহরের আছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। সিলেট হোক সিলেটের মতো। সিলেট আরো বেশি সিলেট হয়ে উঠুক।
সিলেট শহর ও অঞ্চল ইতিহাসের বহু ধারায় উৎকর্ষিত। হাওর-বাওড়, নদী-ছড়া, পাহাড়-টিলা নিয়ে সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক পরিবেশ। সিলেটের অর্থনীতি গতিশীল। সংস্কৃতি আঞ্চলিকভাবে ঐশ্বর্যমণ্ডিত, আবার ইংল্যান্ডের মাত্রা যোগ দিলে আন্তর্জাতিক। সিলেট শহরের বাড়িঘর ও পাড়া-পরিবেশের অবস্থা এখনো অনুপম। সব মিলে সিলেট অনন্য। সিলেট শহরের অনন্য ও নিরুপম অবস্থা ধরে রাখা এবং আরো সমৃদ্ধ করার জন্য প্রয়োজন একটি নতুন নাগরিক কল্পনা ও ভাবনা-চিত্র।
প্রাকৃতিক স্থানসমূহ, চা-বাগান, আউলিয়াদের মাজার, ইংল্যান্ডের সাথে নিবিড় সম্পর্ক, সব মিলিয়ে সিলেট পর্যটক ও ভ্রমণকারীদের গন্তব্যস্থান। সিলেট শহর হতে পারে এই পরিমণ্ডলের আরো গোছানো কেন্দ্রবিন্দু। স্থানীয়, আঞ্চলিক, এমনকি একটি আন্তর্জাতিক বিশিষ্ট স্বরূপের জন্য সিলেট অনবদ্য। এটাই সিলেট শহরের গরিমা।
সিলেট শহরের “প্রবেশদ্বার” বলে খ্যাত কিন ব্রিজ সুরমা নদীর উপর স্থাপিত একটি ধাতব সেতু। তৎকালীন আসাম প্রদেশের গভর্ণর মাইকেল কিন এর নামানুসারে ব্রিজটির নামকরণ করা হয়। আসামের সাথে রেল যোগাযোগের জন্য রেলওয়ে বিভাগ ১৯৩৩ সালে সুরমা নদীর ওপর ব্রিজ নির্মাণের উদ্যোগ নেয় এবং নির্মাণ শেষে ১৯৩৬ সালে ব্রিজটি জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। সেই থেকে এটি সিলেটের অন্যতম দর্শনীয় এবং ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসাবে সবার কাছে পরিচিত।
আসলে কিন ব্রিজ তৈরির আগে সিলেট শহরের বৃদ্ধি ছিল কেবলমাত্র উত্তরমুখী। ব্রিজ তৈরির পরে শহর দক্ষিণেও বাড়তে থাকে। এক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করে সিলেট রেলস্টেশন ও বাসস্টেশন। মূল শহর কেন্দ্র থেকে দূরে, নদীর অপর পারে এই অবকাঠামো স্থাপিত হবার পর পরই গড়ে উঠে বসতি। জীবন যাত্রার অনুষঙ্গ জোগান দিতে বসে যায় দোকানপাট, বাজার-ঘাট।
ছড়া-নদীর জলের জার
প্রাকৃতিক পরিবর্তনের ফলশ্রুতিতে বরফগলা স্রোত অথবা পাহাড়ী গিরিখাত থেকে সৃষ্টি হয়ে যে জলধারা সমুদ্রে মিলায় তার নাম নদী; আর যে নদী তার চেয়েও বড় কোন নদীতে গিয়ে পড়েছে তাকে বলে উপনদী, আর যদি বড় নদী থেকে উৎপন্ন হয় তাহলে শাখা নদী। সেই হিসেবে সিলেট জেলার বরাক বা কুশিয়ারা, সুরমা, মনু, পিয়াইন, বৌলাই সব কটি নদীই উপনদী বা শাখা নদী। এই পাহাড় থেকেই নিঃসৃত অপেক্ষাকৃত ক্ষীণকায় স্রোতধারাকে ইংরেজিতে বলে ‘ব্রুক’, আর বাংলায় বলে ছড়া। সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মতে শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহমান ছড়া মোট ১১টি; যেমনঃ গোয়ালি ছড়া, বড় ছড়া, পালকি ছড়া। আছে অসংখ্য হাওড়, ঝর্ণাধারা। দেশের সর্ববৃহৎ হাওড় হাকালুকি হাওরড়ের নাম শোনেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া বিরল। শুষ্ক মৌসুমে সুপেয় পানির জন্য ছিল বেশ কিছু পুকুর, দীঘি। কিন্তু অপরিকল্পিত ভাবে জলাভূমি ভরাট, নির্বিচারে স্থাপনা নির্মাণ এবং দূষণের ফলে ভীষণ বিপদগ্রস্ত, বিষণ্ণ এই সব জলাধার। প্রদর্শনীর একটি বিশেষ অংশ ছিল প্রতিনিয়ত বদলে যাওয়া এই জলাভূমি। বিষাদাচ্ছন্ন জল ও মাটির নমুনা তুলে আনা হয়েছিল ৭৭টি জারে ভরে। স্বচ্ছ কাচের জারে সারি বেধে দাঁড়িয়ে আছে যেন প্রতিবাদী জল।
কনভেনশন সেন্টার ও আর্ট ক্যাম্পাস
সিলেটের প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক ঘটনা ছাড়াও নতুন ধরনের স্থাপনা নির্মাণ নতুন ঘটনার ক্ষেত্র তৈরি করবে। একটি কনভেনশন সেন্টার এক্ষেত্রে হতে পারে মূল প্রভাবক। হবে নানান সংখ্যক মানুষের সভা, ছোটবড় জটলা, প্রদর্শনী ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বহু মানুষের মিলনস্থল। সবুজ গাছের সারির পিছনে ঘাসে আবৃত বাঁকানো ছাদের এই স্থাপনা যেন স্থানীয় ভূপ্রকৃতির প্রতিরূপ। কনভেনশন সেন্টারের পাশে থাকবে আর্ট ক্যাম্পাস; যেখানে শিল্প-চেতনার চর্চা এবং প্রদর্শনী হবে। সর্বত্রই খোলামেলা চত্বর, হেঁটে-ঘুরে বেড়াবার পরিবেশ।
নদীর পাড়ে নতুন করে সাজানো দোকানসারি
উত্তরে নদীর পাড় ধরে যে রাস্তাটা কাজির বাজার ব্রিজের দিকে চলে গেছে, সেখানে বর্তমানে আছে সারিবাঁধা দোকানপাট। কাঠের স্তম্ভ ও কাঠের কপাটে তৈরি পুরনো আদলের এই দোকানগুলো শহরকে একটি ভিন্ন চরিত্র ও আমেজ দেয়। একটি বড় সমস্যা হলো, দোকানগুলো নদীর পাড় ধরে লাইন করে সাজাবার জন্য, রাস্তা থেকে শহরের সঙ্গে নদীর সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন। তাছাড়া এই স্থাপনাগুলো নদীর দিকে পিছন ফিরে থাকায় নদীবিমুখ হয়ে আছে।এই এলাকায় আমরা একটি বাড়ির ধরন গ্রহণ করেছি যেগুলো সাজানো হবে রাস্তা থেকে নদীর দিকে মুখ করে। একটা বাড়ি থেকে অন্য বাড়ির মধ্যকার জায়গা থাকার কারণে সুরমা নদী রাস্তা থেকে প্রকাশ পাবে। মাঝখানের জায়গাগুলোতে হবে বসার এবং জটলা করার ব্যবস্থা। দোতলা এই বাড়িগুলোর নিচতলায় থাকবে পুনর্বাসিত পুরনো দোকান এবং নতুন দোকানসমূহ। ওপরে ছোট অফিস ও ক্যাফে-রেস্তরাঁ।
শিশুদের পার্ক
পুরো শহর ঘুরেও শুধু শিশুদের জন্য কোনো জায়গা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। স্কুল আর কোচিংয়ের ফাঁকে, ছুটির দিনে, কোথাও নিয়ে ভালো করে বেড়ানোর উপায় নেই। পুরাতন রেলওয়ের গুদামঘর, স্টেশন, রেললাইন এবং এর অন্তর্বর্তী খোলা জায়গাগুলোকে ব্যবহার আর সমন্বিত করে বাচ্চাদের জন্য অভিনব একটি পার্ক গড়ে তোলা যায়।
একপাশে বাচ্চাদের খেলার জায়গা, আরেক পাশে নদী। মাঝখানে একটি বড় প্যাভিলিয়ন; বাঁশের হাল্কা কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে থাকা চালিবন্দরের কথা মনে করিয়ে দেয়। একা একটু শান্ত সময় কাটানো অথবা দলবেঁধে হৈচৈ, প্রয়োজনে বদলে যাবে আয়োজন।
উত্তর পাড়ের সম্ভাবনার চিত্র
কিন ব্রিজের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত আলি আমজাদের ঘড়ি, বিদ্যমান নাট্যশালা এবং আশেপাশের বাড়িঘর মিলে নতুন এক প্রাণবন্ত প্লাজা, যার নাম হতে পারে উত্তর চত্বর। জায়গাটা এখনই শহরের জন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। নদীর ধারে সুন্দর বাঁধানো পথ, পথচারীদের বসবার স্থান, নতুন নাট্যশালা মিলে পুরো জায়গাটা হতে পারে আরো আকর্ষণীয় স্থান। এমন হতে পারে, নতুন একটি থিয়েটার-মিলনয়াতন তৈরি করে এই চত্বরটি হবে সাংস্কৃতিককেন্দ্র। পুরো চত্বর পদচারণের জন্য, যেটা নিরবচ্ছিন্নভাবে উত্তরে চলে যাবে কিন ব্রিজ ধরে, আর নদীর পাড় ধরে পশ্চিম দিকে।
নতুন মিনি চত্বর
নদীর পাড় বরাবর বড় রাস্তা থেকে কিছু ভেতরে হেঁটে গেলেই দেখা যায় আগেকার, একেবারে ইংরেজ আমলের অনেক ঘরবাড়ি । অথবা সেই বাড়িগুলোর আদলে বাংলো ধরনের বাড়িঘর। এক একটি বাড়ি এক এক রকম, ভিন্ন ভিন্ন ছাদের আকার। আবার কোনোটা বিশেষ কাজের জন্য। যেমন- ফিলট্রেশন ঘর, পানির ট্যাঙ্ক ইত্যাদি। তবে সব বাড়িই বহন করছে একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ স্থাপত্যশৈলী। আবার সব বাড়িই কোনো না কোনো সরকারি সংস্থার অধীনে। বাছাই করা এ বাড়িগুলোকে নিয়ে নতুন মানের ক্যাম্পাস রচনা করা যায়।
বাড়িঘরকে সামান্য পরিবর্তন করে আরো কিছু নতুন বাড়ি তৈরি করে পর্যটকের থাকা এবং আপ্যায়নের পরিপাটি ব্যবস্থা করা যায়। নিচতলায় খোলামেলা এইসব কাঠামোর কোনোটা হবে আর্ট বা ক্র্যাফট গ্যালারি, কোনোটা হবে আঁকিয়েদের স্টুডিও আর কোনোটা প্রদর্শনীকেন্দ্র। আবার কোনোটা আগের দোকানপাটের নতুন ব্যবস্থা।
জেল কমপ্লেক্স
শহরের পুরনো জেল কমপ্লেক্স একটা দারুণ সম্ভাবনা। অন্যত্র স্থানান্তরিত হওয়ার পর পুরনো জেল রূপান্তরিত হয়ে সৃষ্ট হবে একটা প্রাণবন্ত পাবলিক প্লেস, হেঁটেবেড়ানোর পরিবেশ। নতুন রূপান্তরে থাকছে পার্ক, দিঘি, বাগান, থিয়েটার কমপ্লেক্স। পুরনো বাড়িগুলোকে রেখে সেখানে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে গানের ও চিত্রকলার স্কুল। জেলের পুরনো দালানগুলোকে পুনর্বাসন তৈরি করে হতে পারে জাতীয় মানের জাদুঘর।